বিষয়বস্তুতে চলুন

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

এটি এই পাতার একটি পুরনো সংস্করণ, যা আলী হায়দার খান (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৭:৩২, ৩০ অক্টোবর ২০০৯ তারিখে সম্পাদিত হয়েছিল (→‎গ্যাস অনুসন্ধান ও এর ফলে সৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয়)। উপস্থিত ঠিকানাটি (ইউআরএল) এই সংস্করণের একটি স্থায়ী লিঙ্ক, যা বর্তমান সংস্করণ থেকে ব্যাপকভাবে ভিন্ন হতে পারে।

{{{name}}}
মানচিত্র

বাংলাদেশে চিরহরিৎ বনাঞ্চলের যেটুকু অবশিষ্ট আছে তার মধ্যে লাউয়াছড়ার সংরক্ষিত বনাঞ্চল অন্যতম। বর্তমান মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত এই বনাঞ্চলকে ১৯৯৬ সালে জাতীয় উদ্যান হিসাবে ঘোষণা করা হয়। মাত্র ১২৫০ হেক্টর আয়তনের এই বন জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। বিলুপ্তপ্রায় উল্লুকের জন্য এ বন বিখ্যাত। উল্লূক ছাড়াও এখানে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির দুর্লভ জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ এবং উদ্ভিদ।

নিরক্ষীয় অঞ্চলের চিরহরিৎ বর্ষাবন বা রেইন ফরেষ্টের মত এখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। সূর্যের আলোর জন্য প্রতিযোগিতা করে এ বনের গাছপালা খুব উচু হয়ে থাকে, এবং অনেক ওপরে ডালপালা ছড়িয়ে চাঁদোয়ার মত সৃষ্টি করে। এই বন এতই ঘন যে মাটিতে সূর্যের আলো পড়েনা বললেই চলে।

ইতিহাস

বাংলাদেশের বিখ্যাত বনগুলোর মধ্যে লাউয়াছড়ার বন অন্যতম। পরিচিতির দিক থেকে সুন্দরবনের পরেই লাউয়াছড়ার বনের অবস্থান। সিলেট বিভাগে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় এ বন অবস্থিত। চিরহরিৎ এ বনে নিরক্ষীয় অঞ্চলের বর্ষাবন বা রেইনফরেষ্টের বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। একসময় বৃহত্তর সিলেটের সর্বত্রই এ ধরণের বন ছিল । তবে বানিজ্যিক চা বাগন সৃষ্টি, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ এবং নির্বিচারে গাছকাটার ফলে ক্রমে সংকুচিত হতে হতে মাত্র কয়েকটি স্থানে চিরহরিৎ এ বর্ষাবনের অস্তিত্ব টিকে রয়েছে।

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের পূর্ববতী নাম পশ্চিম ভানুগাছ সংরক্ষিত বন। বনের অস্তিত্ব ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার পাশাপাশি প্রকৃতি ভ্রমণ ও জনসচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পশ্চিম ভানুগাছ বনের একটি অংশকে ১৯৭৪ সালের বন্যপ্রানী (সংরক্ষণ) (সংশোধন) আইন অনুযায়ী ১৯৯৬ সালে জাতীয় উদ্যান হিসাবে ঘোষণা করা হয়।

ভূপ্রকৃতি

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভূপ্রকৃতি পাহাড়ি মৃত্তিকা গঠিত। উচু নিচু টিলা জুড়ে এ বন বিস্তৃত। বনের মাটিতে বালুর পরিমান বেশি এবং প্রচুর পাথর দেখা যায়। বনের মাটিতে পাতা জমে জমে পুরু স্পঞ্জের মত হয়ে থাকে, জায়গায় জায়গার মাটিই দেখা যায় না। এসব স্থানে জোকের উপদ্রপ খুব বেশি। বনের ভেতর দিয়ে অনেকগুলো ছড়া বয়ে চলেছে। এসব ছড়ার কয়েকটি ছাড়া বাকিগুলোতে শুধু বর্ষার সময়ই পানি থাকে। ছড়ার পানি পরিষ্কার টলটলে এবং ঠান্ডা। যেসব ছড়াতে শুষ্ক মৌসুমেও পানি থাকে সেসব ছড়ার কাছে বন্যপ্রানীর আনাগোনা দেখাযায়।

জীববৈচিত্র্য

লাউয়াছড়ার বনে বাঁশ ঝাড় ও বেতের ঝোপ

জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে লাউয়াছড়ার জাতীয় উদ্যান বাংলাদেশের সমৃদ্ধতম বনগুলোর একটি। আয়তনে ছোট হলেও এ বন দুর্লভ উদ্ভিদ এবং প্রানীর এক জীবন্ত সংগ্রহশালা। বনে প্রবেশের সাথে সাথেই নানা ধরনের বন্য প্রানী, পাখি এবং কীটপতঙ্গের শব্দ শোনা যায়। বনের মধ্যে প্রায় সারাক্ষণই সাইরেনের মত শব্দ হতে থাকে; প্রকৃত পক্ষে এটি এক ধরণের ঝিঝি পোকা বা ক্রিকেটের শব্দ। লাউছড়ার জাতীয় উদ্যানে ৪৬০ প্রজাতির দুর্লভ উদ্ভিদ ও প্রানী রয়েছে। এর মধ্যে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪ প্রজাতির উভচর, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি এবং ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রানী দেখা যায়।

বিলুপ্তপ্রায় উল্লুকের জন্য এ বন বিখ্যাত। বনের মধ্যে কিছু সময় কাটালেই উল্লুকের ডাকাডাকি কানে আসবে। উল্লুক ছাড়াও এখানে রয়েছে মুখপোড়া হনুমান, বানর, শিয়াল, মেছোবাঘ, বন্য কুকুর, ভাল্লুক, বার্কিং ডিয়ার (মায়া হরিণ), বনমোরগ, অজগর সহ নানা প্রজাতির জীবজন্তু এবং পাখি। প্রাকৃতিক পরিবেশে নানা ধরণের অর্কিড দেখতে হলেও এ বনে আসতেই হবে। মায়া হরিন সাধারণত উচ্চতায় ২০‌-২২ ইঞ্চি। এদের বাদামী রঙের দেহ যা পিঠের দিকে ঘিয়ে গাঢ় রং ধারণ করে।

উদ্যানের বন্য পাখির মধ্যে সবুজ ঘুঘু, তুর্কি বাজ, সাদা ভ্রু সাতভায়লা, ঈগল, হরিয়াল, কালোমাথা টিয়া, কালো ফর্কটেইল. ধূসর সাত শৈলী, পেঁচা, ফিঙ্গে, লেজকাটা টিয়া, কালোবাজ, হীরামন, কালোমাথা বুলবুল, ধুমকল প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। সাধারণ দর্শনীয় পাখির মধ্যে টিয়া, ছোট হরিয়াল, সবুজ সুইচোরা, তোতা, ছোট ফিঙ্গে, সবুজ কোকিল, পাঙ্গা, কেশরাজ প্রভৃতির দেখা মিলে।

বিলুপ্তপ্রায় উল্লুক

বাচ্চার সাথে একটি মা উল্লুক

লাউয়াছড়ার বনেই রয়েছে বিপন্ন প্রজাতির উল্লুক বা Hoolock Gibbon। বর্তমানে পৃথিবীজুড়ে এ উল্লুক বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে পৌছে গেছে। লাউয়াছড়ার বনেও এদের সংখ্যা আশংকাজনক হারে কমছে। দুই দশক আগে এই বনে কয়েক হাজার উল্লুক দেখা যেত। কিন্তু বর্তমানে সে সংখ্যা কমতে কমতে শ'খানেকে এসে ঠেকেছে। দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে একসময় হয়তো এই বন থেকে উল্লুক চিরতরে হারিয়ে যাবে। নির্বিচারে বন ধ্বংসের ফলে উল্লুকের বাসস্থান ও খাদ্য সংকট সৃষ্টিই এদের সংখ্যা হ্রাসের প্রধানতম কারন।

উল্লুক সাধারনত সামাজিক হয়ে থাকে এবং পরিবারবদ্ধভাবে বসবাস করে। একটি পরিবারে মা ও বাবা উল্লুক সহ তিন-চারটি বা এর বেশিও উল্লুক থাকতে পারে। এরা উচু গাছের মাথায় থাকতে পছন্দ করে। লম্বা হাত ও পায়ের সাহায্যে এরা এক গাছ থেকে আরেক গাছে যাওয়া আসা করে। লাউয়াছড়ার বনে এ ধরনের ১৪ টি উল্লুক পরিবার আছে। উচ্চস্বরে শব্দ করে এরা নিজেদের এলাকা থেকে অন্য উল্লুকদের সরিয়ে রাখে এবং পরিবারের সদস্যদের অবস্থান নির্ধারণ করে। ভোরবেলা লাউয়াছড়ার বনে গেলে অনেক সময় উল্লুকের দেখা পাওয়া যায়।

পুরুষ উল্লুকের গায়ের রং কুচকুচে কালো এবং ভ্রু সাদা রঙের, কিন্তু মেয়ে উল্লুকের গায়ের রং কিছুটা বাদামি ধূসর রংয়ের হয়ে থাকে। এছাড়া মেয়ে উল্লুকের চোখ ও মুখের চারপাশে গোল হয়ে সাদা লোমে আবৃত থাকে যা অনেকটা মুখোশের মত দেখায়। উল্লুকের প্রধান খাদ্য ফলমূল, পোকামাকড় এবং পাতা। একটি পূর্ণ বয়ষ্ক উল্লুক ৬০ থেকে ৯০ সেন্টিমিটার লম্বা এবং ওজন ৬ থেকে ৯ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। প্রায় ছয় মাস গর্ভধারণের পর মা উল্লুক একটি বাচ্চার জন্ম দেয়। জন্মের সময় বাচ্চা উল্লুকের গায়ের রং থাকে ঘোলাটে সাদা। ছয় মাস পর তা লিঙ্গ অনুসারে কালো বা বাদামি ধূসর রং ধারণ করে। জন্মের ৮ থেকে ৯ বছর পর একটি উল্লুক প্রাপ্তবয়স্ক হয়। উল্লুকের আয়ুষ্কাল ২৫ বছর।

নিসর্গ প্রকল্প ও প্রকৃতি ভ্রমণ

লাউয়াছড়ায় নিসর্গ প্রকল্পের প্রবেশদ্বার
লাউয়াছড়ার ট্রেইলে ভ্রমণরত পর্যটক

নিসর্গ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য স্থানীয় জনগণ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পক্ষগুলোর সাথে বন বিভাগের অংশীদারিত্বের সম্পর্ক সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের সুষ্ঠ সংরক্ষণ ও ব্যবস্হাপনা। বর্তমানে ইউ এস এ আই ডি (USAID) এর আর্থিক সহযোগীতায় দেশের ১৭ টি সংরক্ষিত বনাঞ্চলে এই প্রকল্প চালু আছে। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ও এই প্রকল্পের অর্ন্তভুক্ত।

নিসর্গ প্রকল্পের অধীনে লাউয়াছড়া বনের রক্ষনাবেক্ষন ও ব্যবস্থাপনার কাজে স্থানীয় জনগনকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এর ফলে বনের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টির হয়েছে এবং বনের সংরক্ষণে স্থানীয় জনগনের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে।এই প্রকল্পের আওতায় লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে প্রকৃতি ভ্রমণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নির্দিষ্ট হারে প্রবেশ মূল্য দিয়ে এ বনের ভেতর প্রকৃতি ভ্রমণ করা যায়। প্রকৃতি ভ্রমণের জন্য বনে তিনটি ট্রেইল বা হাটা পথ রয়েছে। প্রশিক্ষিত গাইডের সহায়তায় আধা ঘন্টা, এক ঘন্টা এবং তিন ঘন্টা - এই তিনটি ট্রেইলে বনের একেবারে ভেতর পর্যন্ত যাওয়া যায়। প্রকৃতিকে বিরক্ত না করে তৈরি করা এ তিনটি পথে চোখে পড়বে নানা প্রজাতির কীটপতঙ্গ, গাছপালা, পাখি ও অর্কিড। ভাগ্য ভাল হলে হনুমান, বানর এবং উল্লুকেরও দেখা মিলতে পারে। দেশ বিদেশের অসংখ্য পর্যটক প্রতিদিন লাউয়াছড়ায় প্রকৃতি ভ্রমণে আসে। বছরজুড়েই এই বনে পর্যটকদের আনাগোনা থাকলেও শীতের সময় সবচেয়ে বেশি লোকসমাগম হয়।

গ্যাস অনুসন্ধান ও এর ফলে সৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয়

পরিবেশবাদী ও সচেতন মহলের ব্যাপক প্রতিবাদ সত্ত্বেও ২০০৮ সালের এপ্রিল মাসে বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানী শেভরন লাউয়াছড়া ও এর আশপাশের বনভূমি এলাকাল ত্রিমাত্রিক অনুসন্ধান শুরু করে। ত্রিমাত্রিক অনুসন্ধানের জন্য বনের অভ্যন্তর ও আশপাশের এলাকায় নির্বিচারে বিস্ফোরন ঘটানো হয়। এ সময় বন এলাকায় সৃষ্ট ভূকম্পনে বন্যপ্রানী ও স্হানীয় লোকজন আতংকিত হযে পড়ে, বনের কয়েক জায়গায় আগুন ধরে যায়। লাউয়াছড়া বনে বিস্ফোরন ঘটিয়ে অনুসন্ধানের অনুমতি প্রদানের জন্য তৎকালীন তত্বাবধায়ক সরকারও দেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। এর আগে ১৯৯৭ সালে আরেক বহুজাতির তেল কোম্পানী পরিচালিত এ ধরণের অনুসন্ধানের সময় লাউয়াছড়ার বনের পাশেই মাগুরছড়ায় অনুসন্ধান কুপে ভয়াবহ গ্যাস বিস্ফোরনে পুরো এলাকা মারাত্বক বিপর্যয় ঘটে এবং পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়ে। এ বিস্ফোরনের ফলে কয়েক ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পুড়ে যায়। মাগুরছড়ার বন এখনও সেই ক্ষত বহন করছে।

তথ্যসূত্র

১. লাউয়াছড়া উদ্যানে বাংলাদেশ বন বিভাগ কতৃপ স্থাপিত তথ্য বোর্ড।

বহিঃসংযোগ