সদৃশ পুনর্যোজন
সদৃশ পুনর্যোজন (হোমোলোগাস রিকম্বিনেশন) হচ্ছে এক ধরনের বংশাণুগত পুনর্যোজন (জেনেটিক রিকম্বিনেশন) যেখানে ডিএনএর দুইটি একই রকম বা সামঞ্জস্যপূর্ণ পরমাণু নিজেদের মাঝে স্থান পরিবর্তন করে। সাধারণত কোষ নিজের দ্বি-সূত্রে (ডাবল-স্ট্র্যান্ড) ভাঙনের ফপ;এ ক্ষতিগ্রস্ত ডিএনএকে মেরামত করতে এই পদ্ধতি অবলম্বন করে। দ্বিসূত্র ভাঙনের ক্ষেত্রে দ্বিসূত্রধর ডিএনএর দুইটি সূত্রই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সদৃশ পুনর্যোজন মাইয়োসিস সংঘটনকালীন দশায় ডিএনএ অনুক্রমে নতুন গাঠনিক পরিবর্তনও এনে থাকে। সুকেন্দ্রিক কোষের জননকোষ (গ্যামেট কোষ) তৈরিতে, যেমন প্রাণীর শুক্রাণু এবং ডিম্বাণু তৈরিতে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে থাকে। এই নতুন সৃষ্ট গঠনসম্পন্ন ডিএনএ বংশধরের মাঝে বংশাণুগত বৈচিত্র্য (জেনেটিক ভ্যারিয়েশন) আনে, যা বিবর্তনের ধারায় অভিযোজিত হতে একটি সম্প্রদায়কে সাহায্য করে। [১] ব্যাক্টেরিয়া ও ভাইরাসের স্ট্রেইন ও প্রজাতিদের মধ্যে আনুভূমিক বংশাণু হস্তান্তরকরণেও সদৃশ পুনর্যোজন অবদান রাখে।
ইতিহাস ও আবিষ্কার
[সম্পাদনা]১৯ দশকের শুরুর দিকে উইলিয়াম বেইটসন এবং রেগিনাল্ড পানেট গ্রেগর ইয়োহান মেন্ডেল কর্তৃক বর্ণিত বংশানুগতির সূত্রের বাইরে যায় এরকম উদাহরণ লক্ষ করেন। মেন্ডেল তার স্বাধীন বণ্টন সূত্রে পূর্বসূরী থেকে বংশধরের মাঝে বংশাণুগত বৈশিষ্ট্য স্বাধীনভাবে বন্টিত হওয়া কথা ব্যক্ত করেন। উদাহরণ স্বরূপ, বেড়াল ছানার চুলের রঙ ও লেজের দৈর্ঘ্য স্বাধীন দুইটি বৈশিষ্ট্য। কিন্তু বেইটসন ও পানেট দেখান, এই দঐহিক বৈশিষ্ট্য একে অপরের সাথে বংশাণুগতভাবে সম্পর্কযুক্ত হতে পারে।[২][৩] ১৯১১ সালেটমাস হান্ট মর্গান বংশাণুগত বৈশিষ্ট্যাবলী নিয়ে গবেষণা করে এই মত ব্যক্ত করেন যে, সম্পর্কযুক্ত বংশাণুর মাঝে ক্রসওভার বা উল্লঙ্ঘন হতে পারে।[৪] এই ক্রসওভারে সম্পর্কযুক্ত বংশাণু অপর একটি বংশাণুর সাথে উল্লঙ্ঘিত হয়। এর প্রায় দুই দশক পরেবারবারা ম্যাক্লিন্টক এবং হ্যারিয়েট ক্রেইগটন শুক্রাণু ও ডিম্বাণু তৈরির সময় মিয়োসিসের ফলে ক্রোমোজোমের ক্রসওভার দেখান। [৫][৬] একই বছরে কার্ল স্টার্ন শ্বেত রক্তকণিকার সোমাটিক কোষে ও ত্বকের কোষের মাইটোসিসের সময়ও ক্রসিং ওভার দেখান। যা পরবর্তীতে "রিকম্বিনেশন" নামকরণ করা।[৭]
নকশা
[সম্পাদনা]সদৃশ পুনর্যোজন দুইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ডাবল স্ট্র্যান্ড ভাঙনের মেরামত করতে সক্ষম। হলিডে জাংশন মডেল খ্যাত ডাবল স্ট্র্যান্ড ব্রেক রিপেয়ার পাথওয়ে (DSBR) এবং সিন্থেসিস ডিপেন্ডেন্ট এনিলিং (SDSA) পাথওয়ে।[৮] দুই ক্ষেত্রেরই প্রিথম দিকের ধাপগুলো একই । ডাবলস্ট্র্যান্ডের ভাঙনের পর এমআরএক্স (মানবদেহে এমআরএন) কমপ্লেক্স যেকোন এক পার্শ্বের ডিএনএর সাথে জোড়া লাগে। পরবর্তী ধাপে, ডিএনএ স্ট্র্যান্ডের ৫'র শেষের দিকে দুই ধাপে যুক্ত হয়। যুক্ত হওয়া প্রথম ধাপে, এমআরএক্স কমপ্লেক্স Sae2 নামক প্রোটিনকে কাজে লাগায়। এই প্রোটিনেরা ৫' শেষের দিক ছেঁটে ফেলে এবং ছোট ঝুলন্ত ৩' এর সৃষ্টি করে। দ্বিতীয় ধাপে, ৫'→৩' মুখী গঠন Sgs1 হেলিকেজ এবং Exo1 ও Dna2 নিউকিয়েজ দ্বারা সম্পন্ন হয়। Sgs1 হেলিকেজ হিসেবে ডাবল স্ট্র্যান্ড ডিএনএকে চেইনের মতো খুলে ফেলে এবং এরই মাঝে Exo1 ও Dna2 এর নিউক্লিয়েজ সিংগেল স্ট্রান্ড হয়ে যাওয়া ডিএনএ কে Sgs1 তৈরী করে ছেঁটে ফেলে।[৯]
আরপিএ (RPA) হল এমন এক প্রোটিন, যার সিংগেল স্ট্র্যান্ড ডিএনএর প্রতি বাড়তি আকর্ষণ কাজ করে এবং ৩' ছোট ঝুলন্ত স্ট্র্যান্ডের সাথে যুক্ত হয়। [১০] অন্যান্য আরো কিছু প্রোটিনের সহযোগিতায় এই সম্পূর্ণ কর্ম সম্পাদন হয় এবং এর পরেরি আরএডি৫১ (Rad51) প্রোটিন এবং (ডিএমসি১ প্রোটিন মিয়োসিস ধাপে)আরপিএ আবৃত সিংগেল স্ট্র্যান্ড ডিএনএতে নিউক্লিক এসিডের একটি ফিলামেন্ট ও প্রোটিন তৈরি করে। এই নিউক্লিওপ্রোটিন একই সিকুয়েন্সেরই ডিএনএর খোঁজ শুরু করে দেয় এবং যোগ্য সিকুএন্সের ডিএনএ খুঁজে পেলে এই নিউক্লিওপ্রোটিন স্ট্র্যান্ড ইনভ্যাসন বা স্ট্র্যান্ড হামলা প্রক্রিয়ায় ডিএনএ ডুপ্লেক্সে আক্রমণ করে। মাইটোসিস প্রক্রিয়ায় বিভক্ত কোষে ডিএনএ ডুপ্লেক্সের ধারক মূলতঃ সিস্টার ক্রোমাটিড। এই সিস্টার ক্রোমাটিডের সাথে ক্ষতিগ্রস্ত ডিএনএর মিল রয়েছে। তাই এটি ক্ষতিগ্রস্ত ডিএনএর পুনর্গঠনে সাহায্য করতে পারে। অবশ্য মিয়োসিসে গ্রাহল ডিএনএ সর্বদাই সদৃশ ডিএনএর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ন হয় না। [৮] এই স্ট্র্যান্ড হামলার সময় আক্রমণকারী ৩' ছোট ডিএনএ স্ট্রান্ডের সাথে সদৃশ ক্রোমোজোমের একটি ডি লুপ (D-loop) তৈরি হয়। হামলার পরে, একটি ডিএনএ পলিমারেজ বিস্তার লাভ করে নতুন ডিএনএ সিন্থেসিস শুরু করে। এই পরবর্তন ডি-লুপকে একট ক্রস আকারের গঠন দেয়, যা হলিডে জাংশন নামে পরিচিত। এই ঘটনার পর, সেই হামলাকারী স্ট্র্যাণ্ড থেকেই আরো অধিক ডিএনএ সিন্থেসিস শুরু হয়। এতে হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ক্রোমোজোমের জায়গায় সদৃশ ক্রোমোজম নিজের স্থান পায়।[৮]
প্রযুক্তিগত ব্যবহার
[সম্পাদনা]পুনর্যোজী ডিএনএ প্রযুক্তি (যেমনঃ ইনসুলিন তৈরি) ও বংশাণুগতভাবে পরিবর্তিত জীব (জিনেটিকালি মোডিফাইড অরগানিজমস) তৈরিতে সদৃশ পুনর্যোজনের পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। এখন অব্দি নিম্নোক্ত ক্ষেত্রগুলিতে সদৃশ পুনর্যোজনের ব্যবহার হচ্ছে।[১১]
- বংশাণু নিশানাকরণ (জিন টারগেটিং): বংশাণু নিশানাকরণের মাধ্যমে বংশাণুগতভাবে প্রাণীর ভ্রুণীয় কোষের পরিবর্তন এনে ২০০৭ সালে চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার জিতে নেন মারিও আর ক্যাপেচি, মার্টিন জে ইভান্স এবং অলিভার স্মিথ [১২]
- প্রোটিন প্রকৌশল: [১৩] সদৃশ পুনর্যোজনের পদ্ধতি প্রয়োগে বিজ্ঞানীরা নতুন ধরনের প্রোটিন আবিষ্কারে সক্ষম হয়েছেন। [১৪]
- কর্কটরোগ (ক্যানসার) চিকিৎসা: সদৃশ পুনর্যোজনের স্বল্পতাকে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী BRCA পরিব্যক্তির জন্য দায়ী করা হয়। রোগীভিত্তিক পরীক্ষণে (ক্লিনিকাল ট্রায়াল) ঔষধ প্রয়োগে এই স্বল্পতা কাটানোর চেষ্টা করে ক্যানসারের বিরুদ্ধে সুফল পাওয়া গেছে। [১৫][১৬]
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]- ডিএনএ
- সাদৃশ্য নির্দেশিত মেরামতি (Homology directed repair)
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ Alberts B, Johnson A, Lewis J, Raff M, Roberts K, Walter P, ও অন্যান্য (২০০২)। "Chapter 5: DNA Replication, Repair, and Recombination"। Molecular Biology of the Cell (4th সংস্করণ)। New York: Garland Science। পৃষ্ঠা 845। আইএসবিএন 0-8153-3218-1। ওসিএলসি 145080076।
- ↑ Bateson P (আগস্ট ২০০২)। "William Bateson: a biologist ahead of his time" (পিডিএফ)। Journal of Genetics। 81 (2): 49–58। ডিওআই:10.1007/BF02715900। পিএমআইডি 12532036।
- ↑ "Reginald Crundall Punnett"। NAHSTE, University of Edinburgh। সংগ্রহের তারিখ ৩ জুলাই ২০১০।
- ↑ Lobo I, Shaw K (২০০৮)। "Thomas Hunt Morgan, genetic recombination, and gene mapping"। Nature Education। 1 (1)।
- ↑ Coe E, Kass LB (মে ২০০৫)। "Proof of physical exchange of genes on the chromosomes"। Proceedings of the National Academy of Sciences of the United States of America। 102 (19): 6641–6। ডিওআই:10.1073/pnas.0407340102। পিএমআইডি 15867161। পিএমসি 1100733 ।
- ↑ Creighton HB, McClintock B (আগস্ট ১৯৩১)। "A Correlation of Cytological and Genetical Crossing-Over in Zea Mays"। Proceedings of the National Academy of Sciences of the United States of America। 17 (8): 492–7। ডিওআই:10.1073/pnas.17.8.492। পিএমআইডি 16587654। পিএমসি 1076098 ।
- ↑ Stern, C (১৯৩১)। "Zytologisch-genetische untersuchungen alsbeweise fur die Morgansche theorie des faktoraustauschs"। Biol. Zentbl.। 51: 547–587।
- ↑ ক খ গ Sung P, Klein H (অক্টোবর ২০০৬)। "Mechanism of homologous recombination: mediators and helicases take on regulatory functions"। Nature Reviews Molecular Cell Biology। 7 (10): 739–50। ডিওআই:10.1038/nrm2008। পিএমআইডি 16926856।
- ↑ Mimitou EP, Symington LS (মে ২০০৯)। "Nucleases and helicases take center stage in homologous recombination"। Trends in Biochemical Sciences। 34 (5): 264–72। ডিওআই:10.1016/j.tibs.2009.01.010। পিএমআইডি 19375328।
- ↑ Wold MS (১৯৯৭)। "Replication protein A: a heterotrimeric, single-stranded DNA-binding protein required for eukaryotic DNA metabolism"। Annual Review of Biochemistry। 66: 61–92। ডিওআই:10.1146/annurev.biochem.66.1.61। পিএমআইডি 9242902।
- ↑ Lodish H, Berk A, Zipursky SL, Matsudaira P, Baltimore D, Darnell J (২০০০)। "Chapter 8.5: Gene Replacement and Transgenic Animals: DNA Is Transferred into Eukaryotic Cells in Various Ways"। Molecular Cell Biology (4th সংস্করণ)। W. H. Freeman and Company। আইএসবিএন 0-7167-3136-3।
- ↑ "The Nobel Prize in Physiology or Medicine 2007"। The Nobel Foundation। সংগ্রহের তারিখ ডিসেম্বর ১৫, ২০০৮।
- ↑ Drummond DA, Silberg JJ, Meyer MM, Wilke CO, Arnold FH (এপ্রিল ২০০৫)। "On the conservative nature of intragenic recombination"। Proceedings of the National Academy of Sciences of the United States of America। 102 (15): 5380–5। ডিওআই:10.1073/pnas.0500729102। পিএমআইডি 15809422। পিএমসি 556249 ।
- ↑ Carbone MN, Arnold FH (আগস্ট ২০০৭)। "Engineering by homologous recombination: exploring sequence and function within a conserved fold"। Current Opinion in Structural Biology। 17 (4): 454–9। ডিওআই:10.1016/j.sbi.2007.08.005। পিএমআইডি 17884462।
- ↑ Iglehart JD, Silver DP (জুলাই ২০০৯)। "Synthetic lethality--a new direction in cancer-drug development"। The New England Journal of Medicine। 361 (2): 189–91। ডিওআই:10.1056/NEJMe0903044। পিএমআইডি 19553640।
- ↑ Fong PC, Boss DS, Yap TA, Tutt A, Wu P, Mergui-Roelvink M, Mortimer P, Swaisland H, Lau A, O'Connor MJ, Ashworth A, Carmichael J, Kaye SB, Schellens JH, de Bono JS (জুলাই ২০০৯)। "Inhibition of poly(ADP-ribose) polymerase in tumors from BRCA mutation carriers"। The New England Journal of Medicine। 361 (2): 123–34। ডিওআই:10.1056/NEJMoa0900212। পিএমআইডি 19553641।