২০১৭ গঙ্গাচড়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতা
২০১৭ গঙ্গাচড়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতা | |
---|---|
তারিখ | নভেম্বর ২০১৭ |
অবস্থান | ২৫°৪৫′৩০″ উত্তর ৮৯°১৪′০০″ পূর্ব / ২৫.৭৫৮৩° উত্তর ৮৯.২৩৩৩° পূর্ব |
কারণ | ফেসবুকে নবীকে অবমাননা করে পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে |
পদ্ধতি | প্রতিবাদ, দাঙ্গা, পাথর নিক্ষেপ, অগ্নিসংযোগ |
ক্ষয়ক্ষতি | |
নিহত | ১[১] |
আহত | ১৫[২][৩] |
গ্রেপ্তার | ১০০ [৪][৫] |
২০১৭ গঙ্গাচড়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হল ২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর রংপুরের গংগাচড়া উপজেলায় ঠাকুরপাড়া ও ব্রাহ্মণপাড়া গ্রামে ইসলাম ধর্ম অবমাননার অজুহাতে জামায়াতে ইসলামীর উগ্রপন্থীদের দ্বারা হিন্দুদের উপর করা হামলা।[৬][৭][৮][৯]
ঘটনা সূত্রপাত
[সম্পাদনা]নারায়ণগঞ্জে বসবাসকারী গঙ্গাচড়ার টিটু রায় নামক এক হিন্দু যুবক ফেসবুকে ইসলামের নবীকে অবমাননা করে পোস্ট করেছে এই অভিযোগ করে ৬ নভেম্বর টিটু রায়ের বিরুদ্ধে মুদি দোকানি রাজু মিয়া গঙ্গাচড়া থানায় তথ্য প্রযুক্তি আইনে মামলা করে।[২][১০] কিছু জামায়াতে ইসলামীর উগ্রপন্থীরা তার পোস্টের স্ক্রিনশট নিয়ে কালার প্রিন্ট করে কয়েক দিন ধরে রংপুরের গঙ্গাচড়া, তারাগঞ্জ, নীলফামারী জেলার উপজেলায় মসজিদে মানুষদের উত্তেজিত করে। পরে তারা গংগাচড়া উপজেলায় হিন্দুদের উপর হামলা করে। পরে জানা যায় টিটু রায় অশিক্ষিত। তিনি নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লাতে থাকেন।[১১] তিনি ফেসবুক তেমনভাবে চালাতে জানেন না। তিনি ফেসবুকে কোনো স্ট্যাটাস দেননি। তার ফেসবুক একাউন্ট হ্যাক করে নবীকে কটাক্ষ করে স্ট্যাটাস দেয়া হয়।[৬][১২]
হামলা
[সম্পাদনা]কয়েকদিন ধরে হামলার প্রস্তুতি নেয়া হয়। মাঝে মাঝে উগ্রপন্থীরা মিছিল সমাবেশ করে। ২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর শুক্রবার বেলা সাড়ে ৩টায় জুমার নামাজের সময় মাইকিং করে বলা হয় ইসলাম ধর্মের অবমাননা হয়েছে তাদের বদলা নিতে হবে। দুপুর ২টার দিকে গঙ্গাচড়া উপজেলার খলেয়া ইউনিয়নের শলেয়াশাহ ও বালাবাড়ি গ্রাম এবং পাশের মমিনপুর গ্রামসহ বিভিন্ন মসজিদ-মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে জুমার নামাজের পর দলে দলে লোকজন লাঠিসোটা নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে।[১৩] সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ৮ থেকে ১০ হাজার লোকের সমাগম হয়। তারা সেখানে সমবেত হয়ে রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করে। এ সময় ওই সড়কের দু'পাশে শত শত যানবাহন আটকা পড়ে। উগ্রপন্থীরা সন্ধ্যা পর্যন্ত সড়ক অবরোধ করে যা অব্যাহত রাখে ।
গ্রামের অনেকে গ্রাম ছেড়ে পাশের গ্রামে যায়। পাঁচ হাজারের বেশি বা প্রায় ২০ হাজার উগ্রপন্থী লাঠিসোটা নিয়ে হিন্দুদের উপর হামলা করে। হিন্দুদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট করা হয়। তাদের বাড়ি-ঘর ভেঙে ফেলা হয়। তাতে আগুন লাগানো হয়।[১৪] এতে স্কুল শিক্ষক দীপক, টিটু রায়ের তিনটি ঘর, সুধীর রায়ের ছয়টি ঘর, অমূল্য চন্দ্র রায়ের দুটি ঘর, বিধান চন্দ্র রায়ের দুটি ঘর, কৌশল্য রায়ের দুটি ঘর, কুলীন রায়ের একটি ঘর, দীনেশ রায়ের একটি ঘর, ক্ষীরোদ রায়সহ অনেকের প্রায় ৩০টি বাড়ি পুড়ে যায়।[১৩] উগ্রপন্থীরা হিন্দুদের থেকে প্রায় ৫০টি গরু, ছাগল, হাস-মুরগি নিয়ে যায়। তারা হিন্দুদের ধান, গোলা ঘর, খড়ের গাদাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারা হিন্দুদের দুটি মন্দিরে আগুন লাগায়। তারা মন্দিরের মাইক ও অন্য জিনিস লুট করে। একটি মন্দির আগুনে ভস্ম হয়ে যায়। এছাড়া ব্রাহ্মণপাড়াতে হিরেন বাবু, ধীরেন রায়, মন্টুসহ পাঁচজনের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয় ও ১০টি বাড়িতে ভাংচুর করা হয়।[১৫] প্রশাসনের সামনে হামলাকারীরা লুটপাট চালায়। প্রশাসন শুরুতে কোনো বাঁধা দেয় নি।[১০][১৬] হামলার এক সময় তাদের সাথে পুলিশের কথা কাটাকাটি, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষ বাধে। পুলিশ ৫০ রাউন্ড টিয়ার গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। পুলিশ তাদের উপর গুলি চালায়। এতে জামায়াতে ইসলামের হাবিবুর রহমান নিহত হয়।[১৭] মাহবুব মিয়া, আলীম মিয়া, নাজির হোসেন, আলিম ,জামিল ও পুলিশ সদস্যদের মধ্যে এসআই সেলিম মিয়া, কনস্টেবল নাসির হোসেন ও রফিকুল ইসলামসহ ১১ বা ১৫ জন আহত হন।[২][৩][৬][১৮]
হামলার পর
[সম্পাদনা]হামলার পরে পাঁচ দিন অব্দি শতাধিক হিন্দু খোলা আকাশের নীচে ও ব্রাহ্মণপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঘুমহীন,নিরাপত্তাহীন ও আতঙ্কিত ছিলেন।[১৯] পোড়া ঘরগুলো ধ্বংসস্তূপের মত পড়েছিল। হামলার পর এলাকার পরিস্থিতি থমথমে ছিল। গ্রামে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। শনিবার সকালে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল সেখানে যায়। তারা সে সময় বলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতেই পরিকল্পিতভাবে এই হিন্দু পল্লিতে হামলা চালানো হয়েছে। এই হামলায় পীরগঞ্জ জামায়াতে ইসলামীর আমির,সেক্রেটারি ও ১০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়।[১৩][২০] গঙ্গাচড়া ও কোতয়ালি থানায় দুটি মামলা করা হয়। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আবু রাফা মো. আরিফকে প্রধান করে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাইফুর রহমান এবং সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান নিয়ে তদন্ত কমিটি তৈরি করা হয়। কিন্তু ঠিক সময়ে তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দিতে ব্যর্থ হয়।[২১] টিটু রায়ের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে ৫ নভেম্বর মামলা দায়ের করা হয়। চার্জশীট দেয়ার পরে তিনি ১৪ই নভেম্বর নীলফামারীতে গ্রেফতার হন।[২১][২২] তবে তিনি জামিন পান।[৩][৬] গঙ্গাচড়া থানার মামলাতে ২২৫ জনকে অপরাধী করে এসআই মকবুল হোসেন চার্জশিট দেয়। এর মধ্যে ৪৪ জনকে আদালত ২০২১ সালের ৫ জানুয়ারি কারাগারে পাঠায়।[২]
প্রতিক্রিয়া
[সম্পাদনা]এই হামলার প্রতিবাদে ২০১৭ সালের ১৩ নভেম্বর কেন্দ্রীয় পূজা উদযাপন পরিষদ বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করে।[২৩] ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর এসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট, বাংলাদেশ পরিবেশ আইজীবি সমিতি (বেলা), নিজেরা করি ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করে এই ঘটনার নিন্দা করে ও এর বিচার চায়।[২৪]
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "রংপুরে ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে হামলা-সংঘর্ষ, নিহত ১"। পরিবর্তন। ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ ডিসেম্বর ২০১৭।
- ↑ ক খ গ ঘ "রংপুরে ঠাকুরপাড়ায় তাণ্ডব, ৪৪ জনের জামিন নাকচ"। জাগো নিউজ। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১৩।
- ↑ ক খ গ "রংপুরে হিন্দুদের উপর 'পরিকল্পিতভাবে হামলা'"। DW.COM। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১৩।
- ↑ "রংপুর হামলা: তিন গ্রাম পুরুষশূন্য, গ্রেপ্তার ১০০"। ঢাকাটাইম।
- ↑ "রংপুরে হামলা-আগুন: দুই মামলায় গ্রেপ্তার ৫৩"। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/। ১১ নভেম্বর ২০১৭। ১৪ আগস্ট ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ ডিসেম্বর ২০১৭।
- ↑ ক খ গ ঘ "ভুয়া খবর ঘিরে বাংলাদেশে পাঁচটি বড় ঘটনা"। বিবিসি বাংলা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১৩।
- ↑ "বিক্ষোভের ডাক, 'পিঠ দেওয়ালে' বললেন রানা দাশগুপ্ত"। Sarabangla.net। ২০২০-১১-০৩। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১৩।
- ↑ "ভিসি নিয়োগ ও সাম্প্রদায়িকতার ভিন্নরূপ"। বাংলাদেশ প্রতিদিন। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১৩।
- ↑ "গুজব মহামারির শেষ কোথায়?"। www.bhorerkagoj.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১৩।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ ক খ ওয়াসিফ, ফারুক। "সাম্প্রদায়িক হামলার নকশাগুলো কেন একই রকম?"। প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১৩।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ admin। "রংপুরে হিন্দু বাড়িতে হামলার নেপথ্যে"। উত্তর বাংলা (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১৫।
- ↑ "রংপুরে হিন্দুদের উপর পরিকল্পিতভাবে হামলা"। DW.COM। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১৩।
- ↑ ক খ গ Dhakatimes24.com। "রংপুর হামলা: তিন গ্রাম পুরুষশূন্য, গ্রেপ্তার ১০০"। Dhakatimes News। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১৫।
- ↑ "রংপুরে ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে হামলা-সংঘর্ষ, নিহত ১"। web.archive.org। ২০১৭-১২-১৩। Archived from the original on ২০১৭-১২-১৩। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১৫।
- ↑ "রংপুরে হিন্দু বাড়িতে হামলা-আগুন, সংঘর্ষে নিহত ১"। SAMAKAL (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২১-০৮-১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১৫।
- ↑ "সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মানুরাগ এবং মানবিকবোধ"। opinion.bdnews24.com। ২০১৭-১১-১৪। ২০২১-০৮-১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১৩।
- ↑ প্রতিনিধি, রংপুর; ডটকম, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর। "রংপুরে হিন্দু বাড়িতে হামলা-অগ্নিসংযোগ, সংঘর্ষে নিহত ১"। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। ২০২১-০৮-১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১৫।
- ↑ প্রতিনিধি, রংপুর; ডটকম, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর। "রংপুরে হিন্দু বাড়িতে হামলা-অগ্নিসংযোগ, সংঘর্ষে নিহত ১"। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। ২০২১-০৮-১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১৩।
- ↑ "রংপুরে সহিংসতা: পাঁচ দিন পরও আতঙ্ক পুরো এলাকায়"। Channel 24 (Bangla ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১৩।
- ↑ "রংপুরে সহিংসতার ঘটনায় গ্রেপ্তার ৫৩"। দৈনিক সংগ্রাম। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১৩।
- ↑ ক খ "রংপুরে হিন্দু বাড়িতে আগুন: সময় নিল তদন্ত কমিটি"। বিবিসি বাংলা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১৩।
- ↑ "পুরো দেশ জিম্মি হয়ে আছে"। Bangladesh Pratidin। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১৩।
- ↑ "রংপুরে সহিংসতা: পাঁচ দিন পরও আতঙ্ক পুরো এলাকায়"। channel24bd.tv। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১৩।
- ↑ "রংপুরের ঘটনায় জড়িতদের বিচার দাবি"। risingbd.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১৩।