তিনবার ডাকিল, “কালীপদবাবু!” কেহ কোনো সাড়া দিল না। কেবল সেই বিড়্ বিড়্ বকুনি চলিতে লাগিল। শৈলেন পুনশ্চ উচ্চস্বরে কহিল, “কালীপদবাবু, দরজা খুলুন, আপনার সেই নোট পাওয়া গেছে।” দরজা খুলিল না, কেবল বকুনির গুঞ্জনধ্বনি শোনা গেল।
ব্যাপারটা যে এতদূর গড়াইবে তাহা শৈলেন কল্পনাও করে নাই। সে মুখে তাহার অনুচরদের কাছে অনুতাপবাক্য প্রকাশ করিল না। কিন্তু, তাহার মনের মধ্যে বিঁধিতে লাগিল। সে বলিল, “দরজা ভাঙিয়া ফেলা যাক।”
কেহ কেহ পরামর্শ দিল, “পুলিশ ডাকিয়া আনো—কী জানি পাগল হইয়া যদি হঠাৎ কিছু করিয়া বসে—কাল যেরকম কাণ্ড দেখিয়াছি—সাহস হয় না।”
শৈলেন কহিল, “না—শীঘ্র একজন গিয়া অনাদি ডাক্তারকে ডাকিয়া আনো।”
অনাদি ডাক্তার বাড়ির কাছেই থাকেন। তিনি আসিয়া দরজায় কান দিয়া বলিলেন, “এ তো বিকার বলিয়াই বোধ হয়।”
দরজা ভাঙিয়া ভিতরে গিয়া দেখা গেল—তক্তাপোশের উপর এলোমেলো বিছানা খানিকটা ভ্রষ্ট হইয়া মাটিতে লুটাইতেছে। কালীপদ মেজের উপর পড়িয়া—তাহার চেতনা নাই। সে গড়াইতেছে, ক্ষণে ক্ষণে হাত-পা ছুঁড়িতেছে এবং প্রলাপ বকিতেছে; তাহার রক্তবর্ণ চোখদুটো খোলা এবং তাহার মুখে যেন রক্ত ফাটিয়া পড়িতেছে।
ডাক্তার তাহার পাশে বসিয়া অনেকক্ষণ পরীক্ষা করিয়া শৈলেনকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ইহার আত্মীয় কেহ আছে?”
শৈলেনের মুখে বিবর্ণ হইয়া গেল। সে ভীত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কেন বলুন দেখি।”
ডাক্তার গম্ভীর হইয়া কহিলেন, “খবর দেওয়া ভালো, লক্ষণ ভালো নয়।”
শৈলেন কহিল, “ইঁহাদের সঙ্গে আমাদের ভালো আলাপ নাই—আত্মীয়ের খবর কিছুই জানি না। সন্ধান করিব। কিন্তু, ইতিমধ্যে কী করা কর্তব্য।”
ডাক্তার কহিলেন, “এ ঘর হইতে রোগীকে এখনই দোতলার কোনো ভালো ঘরে লইয়া যাওয়া উচিত। দিনরাত শুশ্রূষার ব্যবস্থা করাও চাই।”
শৈলেন রোগীকে তাহার নিজের ঘরে লইয়া গেল। তাহার সহচরদের সকলকে ভিড় করিতে নিষেধ করিয়া ঘর হইতে বিদায় করিয়া দিল। কালীপদর মাথায় বরফের পুঁটুলি লাগাইয়া নিজের হাতে বাতাস করিতে লাগিল।
পূর্বেই বলিয়াছি, এই বাড়ির উপরতলার দলে পাছে কোনোপ্রকার অবজ্ঞা বা পরিহাস করে এইজন্য নিজের পিতামাতার সকল পরিচয় কালীপদ ইহাদের নিকট হইতে গোপন করিয়া চলিয়াছে। নিজে তাঁহাদের নামে যে চিঠি লিখিত তাহা সাবধানে ডাকঘরে দিয়া আসিত এবং ডাকঘরের ঠিকানাতেই তাহার নামে চিঠি আসিত—প্রত্যহ সে নিজে গিয়া তাহা সংগ্রহ করিয়া আনিত।
কালীপদর বাড়ির পরিচয় লইবার জন্য আর-একবার তাহার বাক্স খুলিতে হইল। তাহার বাক্সের মধ্যে দুই তাড়া চিঠি ছিল। প্রত্যেক তাড়াটি অতিযত্নে ফিতা দিয়া বাঁধা। একটি তাড়াতে তাহার মাতার চিঠি, আর-একটিতে তাহার পিতার। মায়ের চিঠি সংখ্যায় অল্পই, পিতার চিঠিই বেশি।
চিঠিগুলি হাতে করিয়া আনিয়া শৈলেন দরজা বন্ধ করিয়া দিল এবং রোগীর
পাতা:গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড).djvu/৯৪
অবয়ব
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬০৪
গল্পগুচ্ছ