মিকোনিয়াম
মিকোনিয়াম | |
---|---|
প্রতিশব্দ | জন্মমল |
১২-ঘণ্টা-বয়সি নবজাতকের মিকোনিয়াম – বাচ্চার তৃতীয় মলত্যাগ মাপনী: ৫ সে.মি. বাম থেকে ডানে। | |
বিশেষত্ব | শিশুরোগবিদ্যা |
মিকোনিয়াম (ইংরেজি: meconium) বা জন্মমল হলো নবজাতকের জন্মের পর প্রথম ত্যাগকৃত মল। গর্ভস্থ শিশু মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায় যে-সব উপাদান গলাধঃকরণ করে সেগুলো দিয়ে মিকোনিয়াম তৈরি হয়, এগুলো হলো অন্ত্রীয় আবরণী কলা, ল্যানিউগো (সূক্ষলোম), শ্লেষ্মা, উল্বরস (অ্যামনিওটিক তরল), পিত্ত ও পানি। মিকোনিয়াম পরবর্তীতে নির্গত মলের চেয়ে চটচটে ও আলকাতরার মতো আঠালো; এটি প্রায় গন্ধহীন এবং এর বর্ণ সাধারণত খুব গাঢ় জলপাই সবুজ রঙের হয়।[১] উল্বরসের সাথে মিশ্রিত অবস্থায় এটি সবুজাভ, বাদামি বা পীতাভ হয়ে থাকে। জন্মের কয়েকদিনের মধ্যে সাধারণত এটি পুরোপুরি নির্গত হয় এবং ধীরে ধীরে মল হলুদ হওয়া শুরু করে (পরিপাককৃত দুধ)।
নিদানিক তাৎপর্য
[সম্পাদনা]অ্যামনিওটিক তরলে মিকোনিয়াম
[সম্পাদনা]সাধারণত শিশুর জন্ম হওয়ার আগ পর্যন্ত মিকোনিয়াম (জন্মমল) তার অন্ত্রের মধ্যেই থাকে, কিন্তু কখনো কখনো এটি জন্মের আগে বা প্রসব বেদনা ও প্রসবের সময় উল্বরস বা অ্যামনিওটিক তরলে নির্গত হতে পারে। মিকোনিয়াম দ্বারা রঞ্জিত উল্বরস প্রভ্রূণীয় সংকট (ফিটাল ডিসট্রেস)-এর লক্ষণ বলে মনে করা হয়। কিছু গর্ভকালোত্তর গর্ভধারণের ক্ষেত্রে (৪০ সপ্তাহের বেশি গর্ভে থাকলে) প্রভ্রূণীয় সংকট ছাড়াই উল্বরসে মিকোনিয়াম বা জন্মমল পাওয়া যেতে পারে। উল্বরস বা অ্যামনিওটিক তরলে মিকোনিয়াম থাকলে নবজাতকের নাক ও মুখে মিকোনিয়াম ঢুকে গিয়ে মিকোনিয়াম অ্যাসপিরেশন সিনড্রোম হওয়ার ঝুঁকি থাকে, তাই চিকিৎসক বা সেবিকাগণ নবজাতকের জন্মের পরের নাক ও মুখ থেকে চোষক ব্যবহার করে মিকোনিয়াম বের করে নেয়। মিকোনিয়াম কিছু সময় পূর্বে নির্গত হলে এটি পুরো অ্যামনিওটিক তরলে সমসত্ত্বভাবে মিশ্রিত হওয়ার পর্যাপ্ত সময় পায় এবং বাদামি রঙের হয়। অপরদিকে জন্মের একটু আগে মিকোনিয়াম বের হলে অ্যামনিওটিক তরল স্বচ্ছ থাকে, তবে তরলে দলা বা গুচ্ছাকারে মিকোনিয়াম দেখা যায়।
মিকোনিয়াম নির্গত না হওয়া
[সম্পাদনা]মিকোনিয়াম নির্গত না হওয়া কতক রোগের লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যেমন সিস্টিক ফাইব্রোসিস (থলিকাজ তন্তুময়তা) ও হিয়ার্শপ্রুং'জ ডিজিজ। কখনো কখনো অন্ত্রে মিকোনিয়াম (জন্মমল) ঘনীভূত হয়ে আটকে যায়, এই অবস্থাকে বলে মিকোনিয়াম ইলিয়াস। এটি প্রায়শই সিস্টিক ফাইব্রোসিস রোগের প্রথম লক্ষণ হিসেবে প্রকাশ পায়।[২] সিস্টিক ফাইব্রোসিস রোগে অন্ত্রের ইলিয়াম অংশে পিচের মতো কৃষ্ণ-সবুজ ও আঠালো হয়ে যান্ত্রিক অবরোধ তৈরি করে। এরপরে কিছু পৃথক ধূসর-শুভ্র বর্তুলাকার বটিকার মতো মল থাকতে পারে। অবরোধের পরবর্তী অংশে অন্ত্র সরু হয়ে যায় এবং পূর্ববর্তী অংশ ফুলে যায়। কোনো মিকোনিয়াম নির্গত হয় না, জন্মের কিছু সময় পর থেকেই পেট ফুলে যেতে থাকে এবং বমন হয়। প্রায় ২০% সিস্টিক ফাইব্রোসিস রোগীর মিকোনিয়াম ইলিয়াস দেখা দেয়। আবার কিছু ক্ষেত্রে সিস্টিক ফাইব্রোসিস রোগ ছাড়াও মিকোনিয়াম ইলিয়াস হতে পারে।[৩] মিকোনিয়াম ইলিয়াস হওয়ার সাথে সিস্টিক ফাইব্রোসিস রোগের তীব্রতার কোনো সম্পর্ক নেই।[৪] বিভিন্ন উপায়ে এই অবরোধ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।[৫]
ওষুধের জন্য মিকোনিয়াম পরীক্ষা
[সম্পাদনা]জরায়ুতে বাচ্চা ওষুধের সংস্পর্শে এসেছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে মিকোনিয়ামে ওষুধের উপস্থিতি পরীক্ষা করা যেতে পারে। কানাডার একটা গবেষক দল দেখিয়েছেন যে, মিকোনিয়ামে অ্যালকোহলের একটি উপজাত, ফ্যাটি অ্যাসিড ইথাইল এস্টার, পরিমাপ করে তারা গর্ভকালীন মায়ের অতিরিক্ত মদ্যপান শনাক্ত করতে পারে।[৬] মিকোনিয়াম বিশ্লেষণ করে মায়েরা গর্ভকালীন তামাক সেবন করেছেন কি না সেটিও নির্ণয় করা যায়।[৭]
জীবাণুমুক্ততা
[সম্পাদনা]মিকোনিয়াম (জন্মমল) জীবাণুমুক্ত কি না তা এখনো তর্কাতীত নয় এবং আরও গবেষণার দাবি রাখে। যদিও কিছু গবেষক মিকোনিয়ামে ব্যাকটেরিয়ার উপিস্থিতির তথ্য দিয়েছেন,[৮] তথাপি বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। অন্যান্য গবেষকেরা বলেন যে, মিকোনিয়ামের নমুনা সংগ্রহ করার সময় এটি ব্যাকটেরিয়া দ্বারা দূষিত হতে পারে এবং এটি প্রকৃতপক্ষে জন্মের আগ পর্যন্ত জীবাণুমুক্ত।[৯] কিছু গবেষক এটাও দাবি করেন যে, গর্ভে ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে, তবে এটি গর্ভধারণের স্বাভাবিক বিষয় এবং এটি গর্ভস্থ শিশুর অনাক্রম্যতন্ত্র বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার বিকাশে সহায়তা করে ও শিশুর জন্য ক্ষতিকর নয়।[১০]
ব্যুৎপত্তি
[সম্পাদনা]লাতিন ভাষার মিকোনিয়াম শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে গ্রিক μηκώνιον, মিকোনিওন থেকে, যা μήκων, মিকোন-এর ক্ষুদ্রতাবোধক শব্দ; গ্রিক ভাষায় এর অর্থ 'পোস্ত', নবজাতকের জন্মমলের নাম মিকোনিয়াম রাখার পেছনে কিছু কারণ থাকতে পারে বলে মনে করা হয়, যেমন এর আলকাতরাসদৃশ রং দেখতে কিছু কাঁচা আফিম বা এর দ্বারা প্রস্তুত দ্রব্যের মতো; আবার এরিস্টটল বিশ্বাস করতেন যে, মিকোনিয়াম গর্ভস্থ শিশুর ঘুম আসতে সাহায্য করে।[১১][১২][১৩]
অন্যান্য ব্যবহার
[সম্পাদনা]- জীববিজ্ঞানে, মিকোনিয়াম বলতে একটি পোকা বা কীটের মূককীট দশায় নির্গত বিপাকীয় বর্জ্য বুঝায়। অন্যান্য কীটপতঙ্গ যেমন গুবরে পোকা ও কিছুু হাইমেনোপটেরা (অ্যাকিউলিয়াটা) লার্ভা দশার শেষের দিকে মূককীট (পিউপা) হওয়ার পূর্বে মিকোনিয়াম নির্গত করে।
চিত্রশালা
[সম্পাদনা]-
মিকোনিয়াম ত্যাগরত নবজাতক।
-
১৩ ঘণ্টা বয়সি নবজাতকের মিকোনিয়াম।
-
এই চিত্রে একই বাচ্চার মিকোনিয়াম (পূর্ণ গর্ভকালে স্বাভাবিকভাবে জন্ম নেওয়ার ৪৮ ঘণ্টা পরে) ও ১ সপ্তাহ মাতৃদুগ্ধ পান করার পরে ত্যাগকৃত মলের চেহারার তুলনা করা হয়েছে।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ Persis Mary Hamilton, Basic Pediatric Nursing (Maryland Heights MO: Mosby, 1991), 82. আইএসবিএন ৯৭৮-০৮০১৬৫৮৬৯৩
- ↑ Hutchinson, James H (১৯৭৫)। Practical Paediatric Problems (4th সংস্করণ)। London: Lloyd-Luke। পৃষ্ঠা 314। আইএসবিএন 0-85324-114-7। অজানা প্যারামিটার
|name-list-style=
উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য) - ↑ Hekmatnia, Ali। "Meconium Ileus"। অজানা প্যারামিটার
|name-list-style=
উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ] - ↑ Jones, Peter G (১৯৭৬)। Clinical Paediatric Surgery (2nd সংস্করণ)। Oxford: Blackwell। পৃষ্ঠা 74–75। আইএসবিএন 0-632-00089-9। অজানা প্যারামিটার
|name-list-style=
উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য) - ↑ Irish M (২৯ ডিসেম্বর ২০১৫)। Minkes RK, সম্পাদক। "Surgical Aspects of Cystic Fibrosis and Meconium Ileus"। ৩০ এপ্রিল ২০০৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৫ অক্টোবর ২০০৭।
- ↑ Chan D, Knie B, Boskovic R, Koren G. Placental handling of fatty acid ethyl esters: perfusion and subcellular studies. J Pharmacol ExpTher 2004; 310: 75-82.
- ↑ Braun JM, Daniels JL, Poole C, Olshan AF, Hornung R, Bernert JT, ও অন্যান্য (আগস্ট ২০১০)। "A prospective cohort study of biomarkers of prenatal tobacco smoke exposure: the correlation between serum and meconium and their association with infant birth weight"। Environmental Health: A Global Access Science Source। 9 (1): 53। ডিওআই:10.1186/1476-069X-9-53 । পিএমআইডি 20799929। পিএমসি 2944243 । বিবকোড:2010EnvHe...9...53B।
- ↑ Jiménez E, Marín ML, Martín R, Odriozola JM, Olivares M, Xaus J, Fernández L, Rodríguez JM (এপ্রিল ২০০৮)। "Is meconium from healthy newborns actually sterile?"। Research in Microbiology। 159 (3): 187–93। ডিওআই:10.1016/j.resmic.2007.12.007 । পিএমআইডি 18281199।
- ↑ Perez-Muñoz ME, Arrieta MC, Ramer-Tait AE, Walter J (এপ্রিল ২০১৭)। "A critical assessment of the 'sterile womb' and 'in utero colonization' hypotheses: implications for research on the pioneer infant microbiome"। Microbiome। 5 (1): 48। ডিওআই:10.1186/s40168-017-0268-4 । পিএমআইডি 28454555। পিএমসি 5410102 ।
- ↑ Willyard C (জানুয়ারি ২০১৮)। "Could baby's first bacteria take root before birth?"। Nature। 553 (7688): 264–266। ডিওআই:10.1038/d41586-018-00664-8 । পিএমআইডি 29345664। বিবকোড:2018Natur.553..264W।
- ↑ O'Dochartaigh, Simon। "HON Mother & Child Glossary, Meconium"। www.hon.ch। ১ মে ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৭ এপ্রিল ২০১৮। অজানা প্যারামিটার
|name-list-style=
উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য) - ↑ μηκώνιον. Liddell, Henry George; Scott, Robert; পারসিয়াস প্রজেক্টে এ গ্রিক–ইংলিশ লেক্সিকন.
- ↑ "meconium"। Online Etymology Dictionary। ২০১৭-০৮-২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-১১-০৬।
বহিঃসংযোগ
[সম্পাদনা]- উইকিমিডিয়া কমন্সে মিকোনিয়াম সম্পর্কিত মিডিয়া দেখুন।
শ্রেণীবিন্যাস |
---|