সেবা বিপণন
সেবা বিপণন হলো এমন এক বিপণন, যা মূলত এমন কিছু বাজারজাত করে, যা অদৃশ্য, অস্পৃশ্য অথচ শনাক্ত করা যায় এবং এর ব্যবহারে উপযোগিতা নিঃশেষ হয় বা উপকার পাওয়া যায়। বাজারজাতকারী থেকে আলাদা করা যায় না এমন অদৃশ্য যেকোনো কিছুই সেবা বাজারজাতকরণের দৃষ্টিকোণ থেকে সেবা হিসেবে গণ্য হয়। উদাহরণস্বরূপ: হাসপাতাল কর্তৃক প্রদত্ত উপকারের জন্য করা বাজারজাতকরণ হলো একপ্রকারের সেবা বাজারজাতকরণ।
সেবার চারটি প্রধান বৈশিষ্ট্য সেবা বাজারজাতকরণে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। সেবার এই বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:
স্পর্শ-অযোগ্যতা (intangibility) | অবিচ্ছেদ্যতা (inseparability) | পরিবর্তনশীলতা (variability) | পঁচনশীলতা (perishability) |
---|---|---|---|
ক্রয়ের আগে সেবা কখনও দেখা যায় না, সেবার স্বাদ নেয়া যায় না, অনুভব করা যায় না, শোনা বা শ্রবণ করা যায় না, কিংবা ঘ্রাণ নেয়া যায় না।[১] | সেবাদাতা মানুষ কিংবা যন্ত্র যাই হোক না কেন সেবাকে কখনও এর সেবাদাতা থেকে আলাদা করা যায় না।[১] | সেবার মান নির্ভর করে সেবাটি কে দিচ্ছে, কখন, কোথায়, কীভাবে দিচ্ছে তার উপর।[১] | সেবা কখনও ভবিষ্যতে বিক্রয় করা হবে কিংবা ব্যবহৃত হবে- এজন্য সংরক্ষণ করে রাখা যায় না।[১] |
সেবার এই বৈশিষ্ট্যগুলো সেবা বাজারজাতকরণকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। আর সেবা বাজারজাতকরণ মিশ্রণও এই বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় নকশা করা হয়ে থাকে।
সেবা বিপণন মিশ্রণ
[সম্পাদনা]সেবা বাজারজাতকরণ মিশ্রণ বলতে মূলত সেবা বাজারজাতকরণ সংশ্লিষ্ট এমন কয়েকটি উপাদানকে বোঝায়, যেগুলোর আলাদা আলাদা মাত্রা নির্ধারণপূর্বক সেবাকে উত্তম উপায়ে বাজারজাত করা যায় এবং ক্রেতা-ভোক্তার জন্য উত্তম ভ্যালু অফার করা যায়। এই মিশ্রণ মূলত পণ্য বাজারজাতকরণ মিশ্রণ থেকে আলাদা কিছু নয়। পণ্য বাজারজাতকরণ মিশ্রণের প্রথম চারটি উপাদান সেবা বাজারজাতকরণেও প্রযোজ্য। তবে পণ্য থেকে সেবা যেভাবে কিছু বৈশিষ্ট্যে আলাদা হয়ে গেছে, সেভাবে সেবা বাজারজাতকরণ মিশ্রণও পণ্য বাজারজাতকরণ মিশ্রণের অতিরিক্ত আরো তিনটি মিশ্রণ উপাদান গ্রহণ করেছে। অর্থাৎ পণ্য বাজারজাতকরণের 4Ps এবং আরো তিনটি P মিলিয়ে সেবা বাজারজাতকরণ মিশ্রণ বলতে বোঝায় 7Ps। যদিও প্রথম চারটি মিশ্রণ-উপাদানের সংজ্ঞাগতও কিছু পার্থক্য রয়েছে সেবার ক্ষেত্রে। একজন সেবা বাজারজাতকারী এই প্রতিটি মিশ্রণের বিভিন্ন অনুপাতে আলাদা আলাদা কৌশল গ্রহণ করে থাকেন:
সেবা মিশ্রণ | বিবরণ | কৌশল |
---|---|---|
Product (পণ্য) | অদৃশ্য, অস্পৃশ্য, উপযোগিতাপূর্ণ সেবা-পণ্য, যা বাজারজাতকরণের স্বার্থে দৃশ্যমান করার উদ্যোগ নেয়া হয় | দৃশ্যমানতা সৃষ্টি দৃশ্যমান মোড়কীকরণ |
Price (মূল্য) | সেবা সম্মুখিনতায় সেবা সরবরাহকারী ও সেবাগ্রহীতার পারস্পরিক সংস্পর্শে যে মূল্য নির্ধারিত হয় | সরতোলা মূল্য কৌশল মূল্য বৈচিত্র্য |
Place (বণ্টন) | সরাসরি সেবাদাতা থেকে সেবাগ্রহীতা পর্যন্ত পৌঁছানোর কৌশল | সরাসরি বণ্টন এজেন্টের মাধ্যমে বণ্টন বিক্রয়কেন্দ্রের মাধ্যমে বণ্টন |
Promotion (প্রসার) | সেবার গুণাগুণ তুলে ধরে ক্রেতাকে সেবা গ্রহণে প্ররোচিত করা | ব্যক্তিক বিক্রয় বিজ্ঞাপন |
People (জনগণ) | সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ, অর্থাৎ কোম্পানী, সেবাকর্মী এবং সেবাগ্রহীতা সকলেই সেবার মিশ্রণ | অভ্যন্তরীণ বাজারজাতকরণ বাহ্যিক বাজারজাতকরণ মিথষ্ক্রীয় বাজারজাতকরণ |
Process (প্রক্রিয়া) | যে প্রক্রিয়ায়, যন্ত্রকৌশলে সেবা উপস্থাপিত হয় কিংবা সেবা ভোগ করা হয় | সহজতর প্রক্রিয়া সরাসরি প্রক্রিয়া[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] |
Physical evidence (বস্তুগত প্রমাণ) | বস্তুগত প্রমাণ বলতে বোঝায় যে পরিবেশে সেবা সরবরাহ করা হয়, কিংবা ভোগ করা হয় |
সেবা সম্মুখিনতা
[সম্পাদনা]সেবা সম্মুখিনতা (Service encounter), সেবা বাজারজাতকরণের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত, যা ঠিক ঐ সময়টুকুকে বোঝায়, যখন একজন সেবা সরবরাহকারী, সেবাগ্রহীতার মুখোমুখি হোন এবং সেবাগ্রহীতাকে সেবা ক্রয়ে বা যাচাইয়ে প্ররোচিত করেন বা উদ্বুদ্ধ করেন। এই সময়টুকু একজন সেবা বাজারজাতকারীর জন্য এজন্য গুরুত্বপূর্ণ, কেননা সেবা সরাসরি বাজারজাত করা হয়, সেবার ক্ষেত্রে কোনো মধ্যস্থকারীর ব্যবহার মূলত করা যায় না; আর তাই সেবা সরবরাহের মুহূর্তই নিশ্চিত করে সেবাটি বিক্রয় হবে অথবা না। সেবা সম্মুখিনতাকে মোমেন্ট-অফ-ট্রুথ (moment-of-truth)-ও বলা হয়।
সেবা মানের তফাৎ মডেল
[সম্পাদনা]সেবা প্রদান ও গ্রহণের ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত মাত্রার সাথে প্রাপ্ত মাত্রার যে তফাৎ ধরা পড়ে, তাকেই সেবা মানের তফাৎ (Gap) বলে। অর্থাৎ সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে যথাযথ মান বজায় রেখে সেবা প্রদান না করলে আর সেবা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে বা ভোগ করার ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত বা প্রত্যাশিত মানের চেয়ে নিম্নমানের সেবা প্রাপ্ত হলে যথাযথ মান থেকে প্রদানকৃত বা প্রাপ্ত মানের যে পার্থক্য পাওয়া যায় তাকেই সেবা মানের তফাৎ বলে। সেবা মানের তফাৎ একজন বাজারজাতকারীর জন্য খুঁজে বের করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এটি হলো সেবার মান মূল্যায়নের একটি প্রক্রিয়া। সেবার মানের তফাৎ সাধারণত দুভাবে পরিমাপ করা হয়:
- সেবা গ্রহীতা তফাৎ
- সেবাদাতা তফাৎ
সেবা গ্রহীতা তফাৎ
[সম্পাদনা]সেবার মান সম্পর্কে ক্রেতার প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির পার্থক্যকে সেবা গ্রহীতা পার্থক্য বলে।[২] অর্থাৎ ক্রেতা যদি তার প্রত্যাশা অনুযায়ী সেবা না পান, তাহলে তার প্রত্যাশা এবং প্রাপ্ত সেবার মানের মধ্যে যে পার্থক্য দেখা দেয় তাকেই সেবা গ্রহীতা তফাৎ বলে।
সেবাদাতা তফাৎ
[সম্পাদনা]সাধারণত সেবা সরবরাহের ক্ষেত্রে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে যে তফাৎ দেখা যায়, তাকে সেবাদাতা তফাৎ বলে। যেমন: ক্রেতার প্রত্যাশা অনুযায়ী যথার্থ মানের বা উপযোগিতার সেবা যদি সেবাদাতা দিতে না পারে তবে তা একপ্রকার সেবাদাতা তফাৎ। সেবাদাতা তফাৎ চার রকমের হতে পারে:
- তফাৎ ১: ক্রেতার প্রত্যাশা সম্পর্কে না জানা
- অপর্যাপ্ত বাজারজাতকরণ গবেষণা, ক্রেতা-ভোক্তা সম্পর্কে উচ্চস্তরীয় ব্যবস্থাপনার যোগাযোগের অভাবজনিত অজ্ঞতা, সেবা-সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার দিকে নজর না দেয়া কিংবা অপর্যাপ্ত সেবা সুবিধা প্রদান করলে এজাতীয় তফাৎ সৃষ্টি হতে পারে।
- তফাৎ ২: সঠিক সেবা নকশা ও মান বাছাই না করা
- সেবার নকশা যদি নিম্নমানের করা হয়, সেবার মানে যদি ক্রেতার চাহিদার প্রতিফলন না থাকে, কিংবা ক্রেতার প্রত্যাশা অনুযায়ী যদি সেবাকে দৃশ্যমান না করা হয়, তাহলে এজাতীয় তফাৎ দেখা দিতে পারে।
- তফাৎ ৩: সেবা নকশা অনুযায়ী সেবা প্রদান না করা
- মানবসম্পদ নীতিমালায় কিংবা ব্যবস্থাপানায় ত্রুটি থাকলে, ক্রেতাদের ক্রয় আচরণ কিংবা ভোগ আচরণ ত্রুটিপূর্ণ হলে, সেবা মধ্যস্থকারবারীদের সাথে দ্বন্দ্ব, অনুপযুক্ত ক্রেতা-মিশ্রণের কিংবা মূল্যের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতার কারণে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানে ব্যর্থতা ইত্যাদি কারণে এই তফাৎ দেখা দিতে পারে।
- তফাৎ ৪: প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সেবা না দেয়া
- সুষ্ঠ সেবা বাজারজাতকরণ যোগাযোগের অভাব, ক্রেতা প্রত্যাশার অকার্যকর ব্যবস্থাপনা কিংবা প্রসারের মাধ্যমে অতিমাত্রায় প্রতিশ্রুতি দেয়া, কিংবা অনুভূমিক বা সমান্তরাল যোগাযোগের অপর্যাপ্ততা ইত্যাদি কারণে এই তফাৎ সৃষ্টি হতে পারে।
তাই মানসম্পন্ন সেবা বাজারজাত করতে একজন বাজারজাতকারীকে এই তফাৎগুলো উপযুক্ত প্রক্রিয়ায় নজরে রাখতে হয় এবং যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার মাধ্যমে তফাৎগুলো পূরণের চেষ্টা করতে হয়, যাতে ক্রেতার সর্বোচ্চ ভ্যালু নিশ্চিত করা যায়।