হুবাল
একটি সিরিজের অংশ |
---|
প্রাচীন নিকট প্রাচ্যের ধর্ম-সংক্রান্ত |
প্রাক-ইসলামী আরব্য দেবদেবী |
|
বিদেশী উৎসের আরব দেবদেবী |
হুবাল (আরবী: هبل) প্রাক ইসলামিক যুগের একজন উপাস্য দেবতা। মক্কা নগরীর কাবাঘরে হুবালের মূর্তি স্থাপিত ছিলো। তার মূর্তিটি মনুষ্যাকৃতির ছিলো। হুবাল অনুসারীগণ তার সামনে রক্ষিত তীরের সাহায্যে দেবতার মতামত নিত। হুবাল সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় না। উত্তর আরবে (সিরিয়া এবং ইরাক) প্রাপ্ত নবতাইয়া লিপিতে হুবালের কথা বর্ণিত আছে। হুবাল বিশেষ কোন ক্ষমতার(যেমন বৃষ্টির দেবতা বাআল) দেবতা ছিলেন তা স্পষ্ট জানা যায় না। হুবালের উপাসনা এবং রক্ষনাবেক্ষণের ভার ছিলো মক্কার কুরাইশ বংশের উপর্। ৬২৪ খিস্টাব্দে বদরের যুদ্ধে মূর্তিপূজারীগণ মুহাম্মাদের অনুসারী দের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ৬৩০ খিস্টাব্দে মক্কা বিজয়ের পর মুহাম্মদ কাবাঘরের রক্ষিত হুবাল সহ ৩৬০টি মূর্তি ভেঙে ফেলেন।[১]
হিশাম ইবনে আল কালবি লিখিত "' কিতাব আল-আসনাম (মূর্তিপুস্তক)"' বইয়ে হুবালের মূর্তির ডান হাত ভাঙা ছিল এবং তা সোনার হাত দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়েছিলো বলে বর্ণনা করা হয়েছে।।[২]
মক্কায় হুবাল
[সম্পাদনা]হুবাল মক্কা নগরীতে পূজিত দেবতা ছিলেন। কাবা শরীফের হুবালের একটি ছবিকে পূজা করা হতো। কারেন আর্মস্ট্রংয়ের মতানুসারে, উপাসনাগৃহটি হুবালের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত ছিলো এবং কাবা শরীফে রক্ষিত ৩৬০ টি মূর্তির মধ্যে হুবালকে প্রধান দেবতা হিসেবে পূজা করা হতো।
হিশাম ইবনে আল কালবি কিতাব আল আশনামে বর্ণিত আছে, হুবালের মূর্তির ছবিটি মনুষ্যাকৃতির যার ডান হাত ভেঙে ফেলে সেখানে একটি সোনার হাত বসানো হয়েছে। প্রাক ইসলামি যুগের ভাষ্যকার আল আজরাকি বলেছেন যে কাবায় দান সামগ্রী রাখার জন্য একটা ভল্ট রাখা ছিলো। হুবালের উদ্দেশ্যে একশত উট বলি দেওয়া হতো। হিশাম আল কালবি এবং আল আজরাকি উভয়ই উল্লেখ করেছেন ছবির সামনে সাতটি তীর রাখা থাকতো। মৃত্যু, কুমারিত্ব এবং বিবাহের ক্ষেত্রে স্বর্গীয় সিদ্ধ্বান্ত পেতে এগুলো ব্যবহার করা হতো।
আল কালবির মতানুসারে হুবালের ছবিটি সর্বপ্রথম খুজাইমাহ ইবনে মুদরিকাহ ইবনে মুদার কর্তৃক স্থাপিত হয়। ইবনে ইসহাকের বর্ণনানুসারে, আমর ইবনে লুহাজ, কুয়াজা গোত্রের একজন দলপতি, কাবাগৃহে হুবালের ছবি স্থাপন করেন, যেখানে এটাকে সকল গোত্রের প্রধান দেবতা হিসেবে পূজা করা হতো। [৩] আমর উল্লিখিত সময় অনুসারে এটি চতুর্থ শতাব্দীতে সংঘটিত হয়েছিলো। কাবা শরীফের রক্ষণাবেক্ষণের ভার পরবর্তীতে কুরাইশগণ অর্জন করে।
ইবনে আল ক্বলবি কর্তৃক বর্ণিত আছে যে মুহাম্মাদের পিতামহ আব্দুল মুত্তালিব তার দশ সন্তানের একজনকে দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করার প্রতীজ্ঞা করেন। তিনি হুবালের সামনে সংরক্ষিত তীরের সাহায্যে সিদ্ধান্ত নিতে চান কোন সন্তানকে উৎসর্গ করবেন। তীর মুহাম্মাদের পিতা, আব্দুল্লাহ এর দিকে নির্দেশ করে। যদিও পরবর্তীতে আব্দুল্লাহ এর পরিবর্তে ১০০ উট বলি দেওয়া হয়। মুহাম্মাদ ইবনে জরীর আল তাবারির[৪] বর্ণনাসুসারে শিশু মুহাম্মাদ কে আব্দুল মুত্তালিব হুবালের মূর্তির সামনে নিয়ে গেছিলেন।
বদর যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে কুরাইশ বাহিনীর নেতা আবু সুফিয়ান ইবনে হারব পরবর্তী যুদ্ধে জয়লাভের জন্য হুবালের নিকট প্রার্থনা করেন, "হুবাল, তুমি তোমার ক্ষমতা দেখাও"।[৫] ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মাদ মক্কা বিজয়ের পরে কাবা শরীফ থেকে হুবাল সহ ৩৬০ টি মূর্তি সরিয়ে ফেলেন এবং প্রার্থনাগৃহটি আল্লাহর উদ্দেশ্যে পূনরায় উৎসর্গ করেন। [৬]
হুবালের ব্যুৎপত্তি
[সম্পাদনা]আল আজরাকির বর্ণনানুসারে, হুবালের মূর্তিটি মেসোপটেমিয়ার হিট অঞ্চল থেকে মক্কা নগরীতে নিয়ে আসা হয়। বর্তমানে হিট অঞ্চলটি ইরাকে অবস্থিত। ফিলিপ খুরি হিট্টি হুবাল শব্দের সংগে আরামীয় শব্দের মিল খূঁজে পান যার অর্থ শক্তি। সেটার উপর ভিত্তি করে তিনি দাবী করেন হুবালের ছবিটি উত্তর আরব সম্ভবত মোয়াব অথবা মেসোপটেমিয়া থেকে মক্কা নগরীতে আনা হয়। হুবাল শব্দটি সম্ভবত হু এবং বাল সহযোগে গঠিত হয়েছে। হু শব্দের অর্থ শক্তি বা দেবতা এবং বাল অর্থ প্রভু বা খোদা। বাল ছিলেন মোয়াবদের খোদা। দক্ষিণ আরবের বাইরে শুধু মাত্র নাবাতিয় পুঁথিতে হুবালের কথা দেবতা দুশারা এবং মানাওয়াতু (মানাত নামে সমধিক পরিচিত) এর সাথে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে অনেক পুঁথিতে ব্যক্তি বিশেষের নাম হিসেবে হুবালের উল্লেখ আছে যেমন, হুবালের পুত্র।
পুরাণ
[সম্পাদনা]প্যাগান আরবের পুরাণ থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদি থেকে হুবালের আসল পরিচয় বা কাজ বের করা কঠিন। ১৯ শতকের শিক্ষাবিদ জুলিয়াস ওয়েলহাউসেন দাবী করেন হুবাল ছিলেন আল লাতের পুত্র এবং ওয়াদ এর ভাই। ২০ শতকের প্রথম দিকের শিক্ষাবিদ হুগো উইংক্লার হুবালকে চন্দ্রদেবতা হিসেবে দাবী করেন। কিন্তু এটির পক্ষে কোনো প্রাথমিক উৎস পাওয়া যায় না। ইবনে কালবী(র.) এর বই এ ক্ষেত্রে অন্যতম একটি প্রাথমিক উৎস হিসেবে গণ্য করা হয়[৭] এবং তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মক্কার পৌত্তলিকরা মূলত হুবাল দেবতাকে ভাগ্য গণনার দেবতা বলে মনে করত।[৮]
দক্ষিণ আরবীয়রা ট্রিনিটি তত্বে বিশ্বাস করতো। চন্দ্র-পিতা, সূর্য-মাতা এবং সন্ধ্যা তারা(শুক্র গ্রহ)-পুত্র হিসেবে বিশ্বাস করতো।
মিরসিয়া এলিয়েড এবং চার্লস যে. এডামস হুবালকে বৃষ্টির দেবতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। প্রাক ইসলামী যুগে কুরাইশগণ এবং তাদের মিত্র কিনানা এবং তিহামা গোত্র হুবালকে আন্তঃগোত্রীয় যুদ্ধ দেবতা হিসেবে পূজা করতো।
তথ্য উৎস
[সম্পাদনা]- ↑ Karen Armstrong (2000,2002)। Islam: A Short History। পৃষ্ঠা 11। আইএসবিএন 0-8129-6618-X। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন:
|তারিখ=
(সাহায্য) - ↑ Francis E. Peters, Muhammad and the origins of Islam, SUNY Press, 1994, p109.
- ↑ Hafiz Ghulam Sarwar, Muhammad The Holy Prophet (1969).
- ↑ Muhammad ibn Jarir al-Tabari, The History of the Prophets and Kings, 1:157.
- ↑ A. Guillaume, The Life Of Muhammad: A Translation Of Ibn Ishaq's Sirat Rasul Allah, 2004 (18th Impression), op. cit., p. 386.
- ↑ Karen Armstrong (2002). Islam: A Short History. p. 23. আইএসবিএন ০-৮১২৯-৬৬১৮-X.
- ↑ "Book of Idols"। Wikipedia (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২৪-০৭-২৩।
- ↑ Kitab Al Asnam by Hisham ibn-al-Kalbi (737 CE - 819 CE)। ২০১৮-০২-২৬।