“গ্রহনক্ষত্র কোথায় কী ভাবে মিলেছে চোখে পড়ে না, কিন্তু ওরা দুজনে যে মিলেছে অন্তরে অন্তরে সেটা দেখা যাচ্ছে খুব স্পষ্ট করেই।”
“তুমি বুঝবে না আমার কথা। যখনি আমরা জন্মাই তখনি আমাদের যথার্থ দোসর ঠিক হয়ে থাকে। মোহের ছলনায় আর-কাউকে যদি স্বীকার করে নিই তবে তাতেই ঘটে অজ্ঞাত অসতীত্ব। নানা দুঃখে বিপদে তার শাস্তি।”
“যথার্থ দোসর চিনব কী করে।”
“নক্ষত্রের স্বহস্তে স্বাক্ষর-করা দলিল আছে।”
৩
আর লুকোনো চলল না।
আমার শ্বশুর অজিতকুমার ভট্টাচার্য। বনেদি পণ্ডিত-বংশে তাঁর জন্ম। বাল্যকাল কেটেছে চতুষ্পাঠীর আবহাওয়ায়। পরে কলকাতায় এসে কলেজে নিয়েছেন এম.এ. ডিগ্রি গণিতে। ফলিত জ্যোতিষে তাঁর যেমন বিশ্বাস ছিল তেমনি ব্যুৎপত্তি। তাঁর বাবা ছিলেন পাকা নৈয়ায়িক, ঈশ্বর তাঁর মতে অসিদ্ধ; আমার শ্বশুরও দেবদেবী কিছুই মানতেন না তার প্রমাণ পেয়েছি। তাঁর সমস্ত বেকার বিশ্বাস ভিড় করে এসে পড়েছিল গ্রহনক্ষত্রের উপর, একরকম গোঁড়ামি বললেই হয়। এই ঘরে জন্মেছে সুনেত্রা; বাল্যকাল থেকে তার চার দিকে গ্রহনক্ষত্রের কড়া পাহারা।
আমি ছিলুম অধ্যাপকের প্রিয় ছাত্র, সুনেত্রাকেও তার পিতা দিতেন শিক্ষা। পরস্পর মেলবার সুযোগ হয়েছিল বার বার। সুযোগটা যে ব্যর্থ হয় নি সে-খবরটা বেতার বিদ্যুদ্বার্তায় আমার কাছে ব্যক্ত হয়েছে। আমার শাশুড়ির নাম বিভাবতী। সাবেককালের আওতার মধ্যে তাঁর জন্ম বটে, কিন্তু স্বামীর সংসর্গে তাঁর মন ছিল সংস্কারমুক্ত, স্বচ্ছ। স্বামীর সঙ্গে প্রভেদ এই, গ্রহনক্ষত্র তিনি একেবারেই মানতেন না, মানতেন আপন ইষ্টদেবতাকে। এ নিয়ে স্বামী একদিন ঠাট্টা করাতে বলেছিলেন, “ভয়ে ভয়ে তুমি পেয়াদাগুলোর কাছে সেলাম ঠুকে বেড়াও, আমি মানি স্বয়ং রাজাকে।”
স্বামী বললেন, “ঠকবে। রাজা থাকলেও যা না-থাকলেও তা, লাঠি ঘাড়ে নিশ্চিত আছে পেয়াদার দল।”
শাশুড়ি ঠাকরুন বললেন, “ঠকব সেও ভালো। তাই বলে দেউড়ির দরবারে গিয়ে নাগরা জুতোর কাছে মাথা হেঁট করতে পারব না।”
আমার শাশুড়ি আমাকে বড়ো স্নেহ করতেন। তাঁর কাছে আমার মনের কথা ছিল অবারিত। অবকাশ বুঝে একদিন তাঁকে বললেম, “মা, তোমার নেই ছেলে, আমার নেই মা। মেয়ে দিয়ে আমাকে দাও তোমার ছেলের জায়গাটি। তোমার সম্মতি পেলে তার পরে পায়ে ধরব অধ্যাপকের।”
তিনি বললেন, “অধ্যাপকের কথা পরে হবে, বাছা, আগে তোমার ঠিকুজি এনে দাও আমার কাছে„।”
দিলেম এনে। তিনি বললেন, “হবার নয়। অধ্যাপকের মত হবে না। অধ্যাপকের মেয়েটিও তার বাপেরই শিষ্যা।”